এই যে হুনছেন? পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীর ফিসফিস কথা শুনতে পেলেন ইমাম সাহেব। দরজায জানি কেডায় ধাক্কা দেয়।
হুমম শুনছি। স্ত্রীকে আস্তে করে উত্তর দিলেন । তিনি জেগে গেছেন আরো আগেই। এতক্ষণ ইচ্ছে করেই চুপ ছিলেন।
দিনকাল ভালো না। শুনেছেন পাকবাহীনি এখর শহর থেকে গ্রামেও চলে এসেছে। গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তাদের সাথে যোগ হয়েছে শান্তি বাহিনী। রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ নামে গ্রামেরই কিছু মানুষ তাদেরকে সাহায্য করছে। শুনেছেন তাদের পাশের গ্রামেও রাজাকার বাহিনী গঠন হয়েছে। তারা রাতের আঁধারে পাকবাহিনীকে চিনিয়ে দিচ্ছে সেই সব বাড়ি যাদের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কাজেই তাদের গ্রামে আসতে আর কতক্ষণ।
গঞ্জ থেকে মুল যে সড়কটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে তার পাশেই জামে মসজীদ। মসজীদের পেছনেই ইমাম সাহেবের ঘর। অষ্টাদশী এক মাত্র মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি।
শুনেছেন তাদের গ্রামেও দু-চার জন মুক্তিফৌজে নাম লিখিয়েছে। যদিও তিনি সবসময় শান্তির পক্ষে। তারপরেও নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর এমন নিষ্ঠূর অত্যচার তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তবে নিজের এই না মেনে নেওয়াটা কখনোই সর্বসম্মুখে প্রকাশ করেন না। ফলে তিনি এ গ্রামের শান্তি বাহিনীর সুনজরেই আছেন।
তাই এত রাতে দরজা ধাক্কানোর শব্দে তিনিও কিছুটা তটস্ত হয়ে উঠলেন। তবে সাহস হারালেন না। দাঁড়াও দেখাতাছি। বলে তিনি বিছানা ছাড়বার উপক্রম করলেন।
যাইয়েন না। পাশ থেকে স্ত্রী তার হাত টেনে ধরলো।
ভয় পাইয়ো না। আল্লাহ ভরসা। স্ত্রীর হাতে চাপ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বিছানা থেকে নেমে গেলেন তিনি।
টেবিলের উপর থাকা হ্যারিকেন এর সলতেটা উসকে দিলেন। ঘরময় আলো ছড়িয়ে পড়লো। সেই আলোয় চকির নিচ থেকে খড়ম জোড়া টেনে নিয়ে দরোজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
কেডায় ? প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইলেন।
দরজাটা খোলেন হুজুর। গলাটা আর্ত শুনালো।
ইমাম সাহেব গলাটা চিনতে পারলেন না। কিন্তু, কন্ঠস্বরের আকুলতাটা ঠিকই ঠাহর করতে পারলেন।
তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে দরোজা খুললেন। চৌকাঠে একটা মানুষকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখলেন।
তুমি কেডায় বাবা?
মানুষটা মুখ তুললো। চাচা আমি ।
ইমাম সাহেব চিনতে পারলেন। এ গ্রামেরই ছেলে। বেশ আগেই মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। ওকে নিজের দরোজায় দেখে আতঁকে উঠলেন।
তুমি না যুদ্ধে গেছ?
না চাচা এদ্দিন ইন্ডিয়া আছিলাম। ট্রেনীং নিছি। এখন যুদ্ধে যামু। বাড়ি আইছিলাম মা-বাবার সাথে দেহা করতে। কথা বলার ফাঁকে বাম হাতটা ডান হাতের বাাঁহুতে চেপে ধরলো।
হ। আমি বাড়ি আইছি, শান্তিবাহিনী কেমনে জানি টের পায়া যায়। আমারে ধরনের লাইগ্যা অন্ধকারে ঘাপটি মাইরা ছিল। আমি ঘরের থন বাইর হইতেই জাপটাইয়া ধরে। আমি কোনমতে ছাড়াইয়া দৌড় দিসি। হেগো একজনের সামনে পইরা গেছিলাম। হে-ই ছুড়ি মারছে। এক নাগারে কথা বলে থামলো সে। পেছন ফিরে তাকালো। তারপর ইমাম সাহেবের হাতটা ধরে বলল, হুজুর আমারে একটু পলানোর জায়গা দেন।
ইমাম সাহেব প্রমাদ গুনলেন। তার বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। কি করবেন ভেবে পেলেন না।
আপনে ভেতরে আসেন। পেছন থেকে আর একটা কণ্ঠ তাড়া দিল। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন ফিরে দেখলেন ইমাম সাহেব। তার মেয়ে উঠে এসেছে।
কিন্তু মা .... ইমাম সাহেব সবে বলতে শুরু করেছিলেন। আব্বা আপনে জলদি দরজা লাগাইয়া হারিকেনটা নিভান । তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলো মেয়েটা। তারপর ছেলেটা ভেতরে ঢুকতেই তার হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যেয়ে তার রুমের দরোজা লাগিয়ে দিল।
ইমাম সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে মেয়ের কথামত দরোজা লাগিয়ে হারিকেন নিভিয়ে হতবিহব্বল হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তার স্ত্রী কোন কথা না বলে তাকে জোড়সে আকড়ে ধরলো।
ক্ষাণীক বাদেই বাইরে বেশ কিছু পদশব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই দরোজায় ঘা পড়লো।
দরোজা খোলেন হুজুর।
ইমাম সাহেব বুঝে নিলেন। বিপদ যা হবার হয়ে গেছে। তারপরেও বুকে সাহস রাখলেন। তারা একটা মানুষকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করছেন। কাজেই এই চেষ্টাটা তারা চালিয়ে যাবেন। বাকী আল্লাহর ইচ্ছা।
এত রাতে কেডায়? তিনি স্পষ্ট গলায় জানতে চাইলেন।
আমরা শান্তি বাহিনী। কেউ একজন উত্তর দিল। আমরা এক জনরে খুঁজতাছি।
তা আমার বাড়িতে কেন?
হেয় আপনার বাড়িতেই ঢুকছে মনে হয়।
না আমার বাড়িতে কেউ আসে নাই।
দরজাটা খোলেন । আমরা নিজেরা দেখবার চাই।
তিনি মেয়ের ঘরের দরোজার দিকে তাকালেন। অন্ধকারে কিছু দেখতে পেলেন না। তার মনে হলো ওরাও কিছু দেখতে পাবে না।
দাঁড়াও খুলতাছি। তিনি স্ত্রীর আলিঙ্গন ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামলেন। হ্যারিকেন এর আলো বাড়িয়ে পায়ে খড়ম গলিয়ে দরোজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরোজা খুরতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো ওরা। জনা তিনেক লোক। সবাইকেই তার চেনা মনে হলো। ঢুকেই তারা এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই সেদিকে এগিয়ে গেল একজন।
ওইটা আমার বিবি বাবা। ইমাম সাহেব তার সামনে দাঁড়িয়ে ককিয়ে উঠলেন।
সরেন আমাদের দেখতে দেন। ইমাম সাহেবকে সরিয়ে সে এগিয়ে গেলো খাঁটের দিকে। ইমাম সাহেবের স্ত্রী তড়িৎ শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে উঠে বসে গেলেন। আাঁচল টেনে মুখ ঢাকলেন। সেটা দেখে সেদিকে এগোতে থাকা লোকটা থেমে গেলো। তখনি চোখ পড়লো মেয়েটার রুমের দরোজার দিকে। এবার সেদিকে এগোলো।
ওইডা আমার মাইয়ার ঘর বাবা।
ডাকেন ওরে। লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো। তখনি তার চোখ পড়লো ঘরের মেঝের দিকে। ওখানে কালচে একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। উঁবু হয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো। মুহুর্তেই তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। পরক্ষণেই ঘুরে তেড়ে এলো ইমাম সাহেবের দিকে। কেউ আসে নাই না। তাইলে এই রক্ত আইলো কই থাইক্যা।
আ-আ-আমি জা-জা ....ইমাম সাহেব তোতলাতে লাগলেন।
হাত বাড়িয়ে তার কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে আনলো লোকটা । পাশ থেকে বাকী দুজন জাপটে ধরলো ইমাম সাহেবকে।
বল ব্যাটা এই রক্ত কার? ইমাম সাহেবের শরীরটা ধরে ক্রমাগত ঝাঁকাতে লাগলো সে।
লজ্জায় দুঃথে ইমাম সাহেবের চোখে পানি চলে এলো। তিনি কিছু বলতে পারলেন না।
তখনি মেয়েটার রুমের দরোজা খোলে গেল। সবগুলো চোখ এক সাথে ঘুরে গেল সেদিকে।
জানতে চান রক্তটা কার? মেয়েটা দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ-মুখ থেকে আগুন বের হচ্ছে। রক্তটা আমার। কােই থাইক্যা বাইর হইছে দেখতে চান। বলেই নিচু হয়ে তার জামার প্রান্তটা ধরে এক টানে কোমরের কাছে উঠিয়ে ফেলল। আপনাগো মা বোনরে জিগায়েন এই রক্ত পত্যেক মাসে কেন বাইর হয়।
উপস্থিত সবাই দেখলো মেয়েটার সবুজ পাজামার নিম্নাঙ্গ এর সামনের অংশটা লাল হয়ে আছে।
সবাই ওদিকে একবার তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর আর কিছু না বলে তৎক্ষণাত ইমাম সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে দ্রত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু, ইমাম সাহেব তখনো তাকিয়ে থাকলেন। তিনি বিন্দুমাত্রও লজ্জা পেলেন না। তার কাছে মনে হলো তিনি মেয়ের লজ্জাস্থান দেখছেন না। দেখছেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন
আলহামদুলিল্লাহ। প্রায় এক যুগ পরে অন্যপ্রকাশের বিষয়ভিত্তিক প্রতিযোগীতামুলক সাইট গল্প-কবিতা ডট কমে’র গল্প শাখায় আবারো প্রথম পুরস্কার পেলাম। উল্লেখ্য মাঝখানের এই সময়টাতে বিশেষ করে ২০১৫ তে আমার মা মারা যাবার পর থেকে আমি লিখালিখিতেই অনিয়মিত। তারপরেও এত বছর পর এহেন স্বীকৃতি মানে হলো আমি ফুরিয়ে যাইনি। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ভাই-বোন বন্ধুদের যারা সবসময় আমার পাশে ছিলেন। ধন্যবাদ জানাই গল্প-কবিতা ডট কম কর্তৃপক্ষকে যারা আমার মত সামান্য লেখককে বারংবার সম্মানিত করেছেন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
দিনকাল ভালো না। শুনেছেন পাকবাহীনি এখর শহর থেকে গ্রামেও চলে এসেছে। গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।......
২৪ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭০ টি
সমন্বিত স্কোর
১০.০২
বিচারক স্কোরঃ ৮.২২ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।